জরিপ (Surveying) একটি প্রযুক্তিগত ও সৃজনশীল প্রক্রিয়া যার মূল লক্ষ্য হলো নির্দিষ্ট এলাকার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, সীমানা, অবকাঠামো ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা। জরিপলিপি (Field Book) হল মাঠ পর্যায়ে সংগৃহীত তথ্যের লিখিত রূপ, যা পরবর্তী ধাপে নকশা (Map) অঙ্কনে ব্যবহৃত হয়। এই নকশা পরবর্তী পরিকল্পনা, নির্মাণ, ভূমি মালিকানা নির্ধারণ ও আইনি প্রমাণ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আজকের পাঠে আমরা সার্ভেয়িং ১ এর “শিকল জরিপ নকশা“ অধ্যায়ের একটি অংশ — জরিপলিপি হতে জরিপ নকশা অঙ্কন প্রক্রিয়া — বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
Table of Contents
জরিপলিপি হতে জরিপ নকশা অঙ্কন প্রক্রিয়া
১. স্কেল নির্ধারণ
নকশা অঙ্কনের আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো স্কেল নির্ধারণ।
স্কেল হলো মাঠে মাপা প্রকৃত দূরত্ব ও নকশায় প্রদর্শিত দূরত্বের অনুপাত। এটি জরিপের উদ্দেশ্য, জরিপ এলাকার আয়তন ও অর্থ ব্যয়ের পরিমাণের উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয়।
যেমন—
- ছোট এলাকার জন্য বড় স্কেল (১:৫০০) ব্যবহার করা হয়
- বড় এলাকার জন্য ছোট স্কেল (১:৫০০০ বা তার বেশি) ব্যবহার করা হয়
২. ড্রয়িং শিট প্রস্তুতি
- প্রয়োজনীয় আকারের ড্রয়িং শিট নেওয়া হয়
- চারপাশে ২.৫ থেকে ৪ সেন্টিমিটার প্রান্তরেখা (Border Line) টানা হয়
- শিটে নকশার নাম, অবস্থান, স্কেল, উত্তর রেখা, টাইটেল ইত্যাদি সঠিক স্থানে বসানোর ব্যবস্থা করা হয়
- জরিপকৃত এলাকার উত্তর দিক সর্বদা নকশার উপরের দিকে রাখা হয়
৩. ট্রেসিং কাগজে প্রাথমিক কাঠামো অঙ্কন
- প্রথমে ট্রেসিং পেপারে প্রধান জরিপ রেখাগুলো সঠিক স্কেলে আঁকা হয়
- ড্রয়িং শিটে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মানানসই অবস্থান নির্বাচন করা হয়
- পেন্সিল বা আলপিন দিয়ে প্রধান স্টেশনগুলোর বিন্দু চিহ্নিত করা হয়
৪. ভিত্তি রেখা ও স্টেশন চিহ্নিতকরণ
- ট্রেসিং কাগজ সরিয়ে ভিত্তি রেখা (Base Line) সঠিক স্কেলে আঁকা হয়
- মধ্যবর্তী স্টেশনগুলো চেইনেজ অনুযায়ী চিহ্নিত করা হয়
- প্রতিটি স্টেশনের নাম সংখ্যা বা বর্ণ দিয়ে লেখা হয়
৫. ত্রিভুজ কাঠামো অঙ্কন ও যাচাই
- ভিত্তি রেখার উপর অন্যান্য ত্রিভুজ সঠিক প্রক্রিয়ায় আঁকা হয়
- যাচাইয়ের জন্য গ্রন্থি রেখা (Check Line) ব্যবহার করা হয়
- ত্রুটি অনুমোদিত সীমার মধ্যে থাকলে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করা হয়
- সীমা অতিক্রম করলে পুনরায় মাঠ থেকে মাপ সংগ্রহ করতে হয়
৬. অফসেট অঙ্কন
অফসেট (Offset) হলো জরিপ রেখা থেকে লম্বভাবে মাপা দূরত্ব, যা অবকাঠামো বা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের অবস্থান নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়।
দুটি পদ্ধতি আছে—
- সেট স্কয়ারের সাহায্যে: চেইনেজ অনুযায়ী লম্ব আঁকা হয় এবং স্কেলে মেপে বস্তু চিহ্নিত করা হয়
- অফসেট স্কেলের সাহায্যে: শূন্য বিন্দু প্রারম্ভ বিন্দুতে মিলিয়ে চেইনেজ অনুযায়ী সরিয়ে বস্তু চিহ্নিত করা হয়
৭. সাধারণ ভুল এড়ানোর কৌশল
- স্কেল ভুল নেওয়া
- শিকল রেখার শেষ দিক থেকে আঁকা শুরু করা
- অফসেট বাদ দেওয়া
- ভুল পাশে অফসেট আঁকা
- বিন্দু সঠিকভাবে যুক্ত না করা
এসব এড়াতে প্রতিটি ধাপে যাচাই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।
৮. কালি প্রয়োগ
পেন্সিলে অঙ্কন শেষ হলে নকশায় কালি প্রয়োগ করা হয়।
- সর্বদা উপরের দিক থেকে নিচে অগ্রসর হতে হয়
- বাঁকা রেখার জন্য ফ্রেঞ্চ কার্ভ এবং সরল রেখার জন্য স্কেল ব্যবহার করতে হয়
- নির্দিষ্ট রঙ ব্যবহার করা হয়—
- প্রান্ত স্টেশন: কালো কালি বৃত্ত (৬ মিমি)
- জরিপকৃত বস্তু: কালো কালি
- প্রস্তাবিত বস্তু: লাল কালি
- রেললাইন ও পাইপলাইন: গাঢ় নীল কালি
- মধ্যরেখা: কালো ডটেড লাইন
- জরিপ রেখা: গাঢ় লাল ডটেড লাইন
৯. প্রতীক ও চিহ্ন ব্যবহার
নকশায় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রতীক ব্যবহার করতে হয়—
- রাস্তা: ডাবল লাইন
- গাছ: সবুজ কালি দিয়ে ছোট বৃত্ত
- নদী: নীল ঢেউ-আকৃতির লাইন
- ভবন: কালো ব্লক
১০. নামপত্র ও তথ্য উপস্থাপন
নকশার ডানদিকের নিচে টাইটেল ব্লক স্থাপন করা হয়, যেখানে থাকে—
- নকশার নাম
- অবস্থান
- জরিপকারীর নাম
- ক্ষেত্রফল
- স্কেল
- তারিখ
উত্তর রেখা সাধারণত উপরের বাম কোণে বসানো হয়।
১১. রং প্রয়োগের কৌশল
- রং করার আগে শিট পরিষ্কার করতে হয়
- হালকা করে একবারে রং তৈরি করতে হয়
- এক জায়গায় বারবার রং প্রয়োগ করা উচিত নয়
- বড় এলাকা রং করার আগে ব্রাশ বা স্পঞ্জ দিয়ে ভিজিয়ে নিতে হয়
১২. রং প্রয়োগে সতর্কতা
- বিভিন্ন বস্তু আলাদা রঙে প্রদর্শন করতে হবে
- প্রয়োজনীয় রঙের হালকা শেড তৈরি করতে হবে
- রং প্রয়োগের পর শিট শুকিয়ে নিতে হবে

জরিপলিপি হতে জরিপ নকশা অঙ্কন একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও মনোযোগী কাজ। এটি শুধু একটি চিত্র নয়, বরং একটি এলাকার ভৌগোলিক ও অবকাঠামোগত বাস্তব চিত্রের দলিল। সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এবং প্রতিটি ধাপে যাচাই প্রক্রিয়া বজায় রেখে তৈরি করা নকশা প্রকল্প পরিকল্পনা, নির্মাণ ও আইনি কাজে অমূল্য ভূমিকা পালন করে।