জরিপ (Survey) হল একটি প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে পৃথিবীর পৃষ্ঠে অবস্থিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক (নদী, পাহাড়, গাছ) ও কৃত্রিম (রাস্তা, ভবন, সীমানা) বস্তুর সঠিক অবস্থান, আপেক্ষিক উচ্চতা, দিক, রৈখিক ও কৌনিক দূরত্ব পরিমাপ করা হয় এবং নির্দিষ্ট স্কেলের সাহায্যে তা সমতল কাগজে উপস্থাপন করা হয়।
প্রাচীনকাল থেকে জরিপ মানব সভ্যতার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আধুনিক যুগে স্যাটেলাইট ইমেজারি, ড্রোন জরিপ, ও ডিজিটাল ম্যাপিং প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়লেও ভূমি জরিপের গুরুত্ব কখনো কমেনি—কারণ বাস্তব পরিমাপের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যই সবচেয়ে নির্ভুল ও আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য।
Table of Contents
ভূমণ্ডলীয় জরিপ ও সমতলীয় জরিপের পার্থক্য
(সার্ভেয়িং–১: জরিপের ধারণা)
পৃথিবীর বক্রতা ও জরিপের প্রয়োজনীয়তা
পৃথিবী সম্পূর্ণ সমতল নয়, বরং একটি জিওইড আকৃতির (Geoide Shape) বস্ত্ত। এর পৃষ্ঠে বক্রতা (Curvature) বিদ্যমান। বৃহৎ এলাকা জরিপে এই বক্রতা উপেক্ষা করলে দূরত্ব ও কোণ পরিমাপে ভুল সৃষ্টি হয়, যার ফলে মানচিত্রে বিকৃতি ঘটে।
- বৃহৎ এলাকার ক্ষেত্রে:
১০০ বর্গ মাইল (প্রায় ২৫৯ বর্গ কিমি) বা তার বেশি এলাকা জরিপের সময় পৃথিবীর বক্রতা হিসাব করা বাধ্যতামূলক। প্রতি ৩৪.৫ মাইল (৫৫.৫ কিমি) দূরত্বে গড়ে পৃথিবীর পৃষ্ঠ ১ ফুট (০.৩০৪৮ মিটার) বেঁকে যায়। - ক্ষুদ্র এলাকার ক্ষেত্রে:
ছোট এলাকা (যেমন প্লট, বিল্ডিং সাইট) জরিপে বক্রতার প্রভাব এতটাই নগণ্য যে তা উপেক্ষা করা যায়। এই পদ্ধতিতেই সমতলীয় জরিপ পরিচালিত হয়।
ভূমণ্ডলীয় জরিপ (Geodetic Survey)
সংজ্ঞা
এমন জরিপ পদ্ধতি যেখানে পৃথিবীর বক্রতা ও আকার বিবেচনা করে বৃহৎ এলাকা পরিমাপ ও মানচিত্রায়ন করা হয়, তাকে ভূমণ্ডলীয় জরিপ বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য
- পৃথিবীর বক্রতা বিবেচনা করা হয়
- অত্যন্ত বৃহৎ এলাকা (১০০ বর্গ মাইল বা তার বেশি) জরিপে ব্যবহৃত
- জটিল গাণিতিক হিসাব ও উচ্চ নির্ভুলতা প্রয়োজন
- ত্রিকোণমিতিক জরিপ (Triangulation), স্যাটেলাইট জরিপ ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়
- আন্তর্জাতিক সীমারেখা, মহাসড়ক, রেলপথ, বৃহৎ সেতু, বাঁধ, ও প্রতিরক্ষা অবকাঠামো প্রকল্পে প্রয়োগ
সমতলীয় জরিপ (Plane Survey)
সংজ্ঞা
এমন জরিপ পদ্ধতি যেখানে পৃথিবীকে সমতল ধরা হয় এবং বক্রতার প্রভাব উপেক্ষা করে ছোট এলাকা জরিপ করা হয়, তাকে সমতলীয় জরিপ বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য
- পৃথিবীকে সমতল ধরা হয়
- স্বল্প এলাকা (১০০ বর্গ মাইলের কম) জরিপে ব্যবহৃত
- সাধারণ গণনা ও দ্রুত কাজ সম্পন্ন করা যায়
- চেইন জরিপ (Chain Survey), কম্পাস জরিপ (Compass Survey), প্লেন টেবিল জরিপ (Plane Table Survey) ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত
- জমি ভাগ-বন্টন, বিল্ডিং নির্মাণ, রাস্তা পরিকল্পনা, ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পে প্রয়োগ
ভূমণ্ডলীয় জরিপ ও সমতলীয় জরিপের পার্থক্য
বিষয় | ভূমণ্ডলীয় জরিপ (Geodetic Survey) | সমতলীয় জরিপ (Plane Survey) |
এলাকার পরিসর | ১০০ বর্গ মাইল (২৫৯ বর্গ কিমি) বা তার বেশি | ১০০ বর্গ মাইলের কম |
পৃথিবীর বক্রতা | বিবেচনা করা হয় | উপেক্ষা করা হয় |
সঠিকতা (Accuracy) | অত্যন্ত বেশি | তুলনামূলক কম |
ব্যবহার | আন্তর্জাতিক সীমারেখা, বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প | সাধারণ স্থাপত্যকাজ, ছোট প্রকল্প |
যন্ত্রপাতি | উন্নত যন্ত্র (থিওডোলাইট, স্যাটেলাইট GPS) | সাধারণ যন্ত্র (চেইন, কম্পাস) |
গণনা পদ্ধতি | জটিল ও বৈজ্ঞানিক | তুলনামূলক সহজ |
সময় ও খরচ | বেশি | তুলনামূলক কম |
উদাহরণ | জাতীয় মহাসড়ক জরিপ, স্যাটেলাইট জরিপ | জমি জরিপ, বিল্ডিং লে-আউট জরিপ |
ভূমণ্ডলীয় জরিপ ও সমতলীয় জরিপ উভয়ই জরিপ বিজ্ঞানের অপরিহার্য অংশ। প্রকল্পের আকার, নির্ভুলতার প্রয়োজনীয়তা, ও আর্থিক সক্ষমতা অনুযায়ী সঠিক জরিপ পদ্ধতি নির্বাচন করা জরুরি। ছোট এলাকা জরিপের জন্য সমতলীয় জরিপ যথেষ্ট হলেও, বৃহৎ এলাকা ও উচ্চ নির্ভুলতা প্রয়োজন এমন কাজে ভূমণ্ডলীয় জরিপ অপরিহার্য।
নিচে ভূমণ্ডলীয় জরিপ ও সমতলীয় জরিপের পার্থক্য দেয়া হলো :
পার্থক্যের বিষয় | ভূমণ্ডলীয় জরিপ | সমতলীয় জরিপ |
১. ভূমির প্রকৃতি | বক্রতা ধরা হয়। | বক্রতা ধরা হয় না। |
২. ভূমি পৃষ্ঠের পরিমাণ | বৃহৎ পরিমাণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ। | ক্ষুদ্র পরিমাণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ। |
৩. পরিমাপ | দিক, দূরত্ব ও উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়। | শুধুমাত্র সমতল পরিমাপ করা হয়। |
৪. মানচিত্রের মাত্রা | তুলনামূলকভাবে ছোট স্কেলে অঙ্কন করা হয়। | তুলনামূলকভাবে বড় স্কেলে অঙ্কন করা হয়। |
৫. যন্ত্রের ধরণ | সূক্ষ্ম নির্ভুল যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। | অপেক্ষাকৃত কম সূক্ষ্ম যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। |
৬. হিসাবের ধরন | জটিল হিসাব করতে হয়। | অপেক্ষাকৃত সহজ হিসাব করতে হয়। |
৭. প্রধান ব্যবহার | বৃহৎ এলাকার জন্য প্রয়োগ। | ক্ষুদ্র এলাকার জন্য প্রয়োগ। |
৮. পৃথিবীর পরিধি | পৃথিবীর বক্রতা ধরা হয়। | পৃথিবীর বক্রতা ধরা হয় না। |
৯. পরিমাপের একক | মিটার, কিলোমিটার ইত্যাদি একক ব্যবহৃত হয়। | ফুট, ইঞ্চি, মিটার ইত্যাদি একক ব্যবহৃত হয়। |
১০. উদাহরণ | দেশ, মহাদেশ ইত্যাদির মানচিত্র তৈরি। | ছোট এলাকা, ভবন ইত্যাদির মানচিত্র তৈরি। |
১১. পরিমাপের সীমা | ২৬০ বর্গকিলোমিটারের বেশি ক্ষেত্রে প্রয়োগ। | ২৬০ বর্গকিলোমিটারের কম ক্ষেত্রে প্রয়োগ। |
১২. পৃথিবীর ক্ষেত্রফল নির্ণয় | গোলাকার পৃথিবীর ক্ষেত্রফল নির্ণয় করা হয়। | সমতল পৃথিবীর ক্ষেত্রফল নির্ণয় করা হয়। |