জরিপ যন্ত্রপাতির তত্ত্বাবধান ও সমন্বয়করণ

জরিপ যন্ত্রপাতির তত্ত্বাবধান ও সমন্বয়করণ – পাঠটি “সার্ভেয়িং ১” জরিপের ধারণা ” বিভাগ এর একটি পাঠ । জরিপের কাজে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয়। এদের মধ্যে সরাসরি দূরত্ব মাপার জন্য শিকল, টেপ ইত্যাদি, কৌণিক পরিমাপ গ্রহণের জন্য কম্পাস, থিওডোলাইট, সেক্সট্যান্ট ইত্যাদি এবং লেভেলিং-এর ক্ষেত্রে লেভেল যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। এগুলোর মধ্যে কতকগুলো খুবই সূক্ষ্ম পরিমাপ গ্রহণের জন্য ব্যবহৃত হয়, যেমন— লেভেল যন্ত্র, থিওডোলাইট ইত্যাদি।

 

জরিপ যন্ত্রপাতির তত্ত্বাবধান ও সমন্বয়করণ | জরিপের ধারণা | সার্ভেয়িং ১

জরিপ যন্ত্রপাতির তত্ত্বাবধান ও সমন্বয়করণ

এগুলো খুবই সতর্কতার সাথে ব্যবহার ও নাড়াচাড়া করতে হয়। কেননা অসতর্কতার কারণে এগুলোর বিভিন্নাংশ টিলা বা বিকল হতে পারে। সূক্ষ্ম যন্ত্র ব্যবহারকালে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে, যে-কোনো যন্ত্র একবার বিকল হলে পুনরায় এটাকে যত নিপুণভাবেই মেরামত করা হোক না কেন, এটা আর মূল অবস্থায় ফিরে আসে না। তাই যন্ত্রের তত্ত্বাবধানে নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক ঃ

(ক) কোনো যন্ত্র বাক্স হতে বের করার সময় বাক্সে যন্ত্রের বিভিন্নাংশের অবস্থান সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রয়োজনে নোট বা খসড়া চিত্র এঁকে রাখাই উত্তম। এতে যন্ত্র পুনরায় বাক্সে রাখার কালে বিপত্তিতে পড়তে হয় না এবং যন্ত্রের কোনো অংশে অস্বাভাবিক চাপ পড়ে বিকল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। 

(খ) লেভেল, থিওডোলাইট বা এ জাতীয় যন্ত্র বাক্স হতে বের করার সময় দূরবীক্ষণ, স্ট্যান্ডার্স বা অন্য কোনো অংশে না ধরে বরং লেভেলিং বেস (base) প্লেটের নিচে হাত দিয়ে ধরে বের করা উচিত। 

(গ) যন্ত্র তেপায়ার মাথায় আটকানোর পূর্বে তেপায়া স্বাভাবিকভাবে খুলে নিতে হবে এবং তেপায়ার পদত্রয় ভূমিতে সমবাহু বা তদসাদৃশ্য ত্রিভুজ সৃষ্টি করে বক্ষ উচ্চতায় রেখে পদত্রয়ে চাপ দিয়ে মাটিতে এঁটে দিতে হবে। এতে যন্ত্র উল্টে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে না এবং যন্ত্র দৃঢ়ভাবে থাকবে। 

 

জরিপ যন্ত্রপাতির তত্ত্বাবধান ও সমন্বয়করণ | জরিপের ধারণা | সার্ভেয়িং ১

 

(ঘ) যন্ত্রকে তেপায়ার সাথে আকটানো স্ক্রু দিয়ে ভালোভাবে আটকাতে হবে।

(ঙ) যদি যন্ত্ৰ পেভমেন্ট বা অন্য কোনো দৃঢ় মসৃণ পৃষ্ঠে স্থাপন করতে হয়, তবে ফাটল বা জোড়ায় তেপায়ার পদত্রয় আটকে দিতে হবে যেন পিছলে (Slip) যেতে না পারে। নতুবা তেপায়া পিছলে যন্ত্র পড়ে যেতে পারে।

(চ) ফুটপাতে, চলার পথে বা প্রবল বাতাসে যন্ত্র অরক্ষিত অবস্থায় রাখা যাবে না। এতে যানবাহন বা মানুষের ধাক্কায় বা প্রবল বাতাসে যন্ত্র উল্টে পড়ে বিনষ্ট হতে পারে।

(ছ) যন্ত্র তেপায়ার মাথায় ভালভাবে আটকিয়ে কাঁধে করে স্থানান্তর করা উচিত। তবে স্থানান্তরের দূরত্ব অধিক হলে বাক্সে পুরে স্থানান্তর করাই উত্তম। কাঁধে করে স্থানান্তর করার সময় তেপায়ার এক পা কাঁধের সামনের দিকে এবং দু’পা পিছনের দিকে থাকবে ।

(জ) স্থানান্তরের সময় যন্ত্রের স্ক্রুগুলো স্বাভাবিকভাবে এঁটে দিতে হবে যেন যন্ত্রের বিভিন্নাংশের মধ্যে ঘর্ষণজনিত কারণে ক্ষতি হতে না পারে ।

(ঝ) স্থানান্তরে পথের উচ্চতা কম হলে বা স্বল্প পরিসরে গমন করতে হলে যন্ত্র হাতের বাহুর উপর রেখে স্থানান্তর করতে হবে।

(ঞ) যন্ত্রকে রোদের খরতাপ, ধুলাবালি বা বৃষ্টির হাত হতে রক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে রোদের খরতাপে ছাতা, ধুলাবালি ও বৃষ্টির হাত হতে রক্ষার জন্য পানিরোধী হুড (Waterproof hood) ব্যবহার করতে হবে।

(ট) যখন দূরবীক্ষণ ব্যবহার করা হবে না তখন এটাকে ক্যাপ (Cap) দিয়ে রাখতে হবে। 

(ঠ) লেন্স যদি কোনো কারণে ভিজে যায় তবে মুছে শুষ্ক করে নিতে হবে।

(ড) যদি লেন্সে ধুলাবালি পড়ে তবে মসলিন বা সিল্কের কাপড় দিয়ে ঘষা যাবে না বা একটির সাথে অন্যটি ঘষা যাবে না। এতে লেন্সে আঁচড়ের দাগ পড়ে। তাই ধুলাবালি পরিষ্কারের জন্য উটের পশমের তৈরি ব্রাশ ব্যবহার করতে হবে। 

(ঢ) ভার্টিক্যাল সার্কেলে ধরে যন্ত্র নাড়াচাড়া করা যাবে না এবং এটার দাগাঙ্কিত অংশে ধুলাবালি জমা হলে প্রথমে উটের পশমের তৈরি চিকন ব্রাশের সাহায্যে এবং পরে উৎকৃষ্টমানের ‘ওয়াচ অয়েল’ ব্যবহার করে অতি সতর্কতার সাথে পরিষ্কার করতে হবে। 

(ণ) যন্ত্রের স্ক্রু ও অন্যান্য ঘূর্ণন বা চলনযোগ্য অংশ শক্তি প্রয়োগে না ঘুরিয়ে বরং ভালভাবে পরিষ্কার করে উন্নতমানের ‘ওয়াচ অয়েল’ (Watch-oil) লুব্রিক্যান্ট হিসেবে ব্যবহার করে সহজভাবে ঘুরানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

(ত) যন্ত্রের কোনো স্ক্রু খুব শক্তভাবে আটকানো যাবে না বরং পিছলে না যাওয়ার মতো শক্ত করে আটকাতে হবে।

 (থ) সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় কাজ করাকালে যন্ত্রের বাইরের অংশগুলোতে ওয়াচ অয়েল স্বাভাবিকভাবে লাগিয়ে নিতে হবে। এতে যন্ত্র অক্সাইডে আক্রান্ত হবে না। অক্সাইডের দাগ মোছার জন্য যন্ত্রে ওয়াচ অয়েল দিয়ে কয়েক ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর শুকনো অবস্থায় নরম নাইলন কাপড় দিয়ে ঘষে দাগ উঠাতে হবে। পানি ও ধুলাবালির দাগ উঠাবার জন্য প্রথমে উটের পশমের তৈরি চিকন মসৃণ নরম ব্রাশ ব্যবহার করতে হবে। পরে ওয়াচ অয়েল ব্যবহার করে শুষ্ক অবস্থায় মৃদুভাবে ঘষে উঠাতে হবে। যন্ত্রে তেল থাকা বা ভিজা থাকা মানে ধুলাবালি আটকাতে সুবিধা করে দেয়া, কাজেই যন্ত্ৰ ভালোভাবে মুছে শুষ্ক করে নিতে হবে।

(দ) স্টিল টেপ ভালোভাবে মেজে পরিষ্কার শুকনো কাপড়ে মুছে নিতে হবে এবং এরপর সামান্য তৈলাক্ত কাপড়ে মুছে নিলে বন্ধ রাখা উত্তম । গিঁট বা মোচড় লাগা অবস্থায় টেপ টানা উচিত নয়। টেপকে অযথা জার্কিং (Jerking) করা অনুচিত । 

(ধ) কম্পাস কাঁটা অযথা দুলতে (Swing) দেয়া উচিত নয়। ব্যবহার না করা কালে আল (Pivot) উপরে উঠিয়ে কাঁটার দুলনতাত্ত্বিক ভালো হয়। কখনও টেপের উপর দিয়ে যানবাহন চলতে দেয়া উচিত নয়।  নির্দেশক কম্পাস কাঁটা সোজা ও সঠিক রাখার ব্যবস্থা করা আবশ্যক ।

জরিপ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সম্পর্কে জরিপকরের সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। যন্ত্রপাতি নিরীক্ষা (test) ও সমন্বয় সম্পর্কে জরিপকরের পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান থাকা দরকার। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায়ই যন্ত্র নির্মাণ ও সংযোজনের জ্ঞান থাকতে হবে, এমন ধারণা করা অনুচিত। যন্ত্রের সমন্বয় ব্যতীত জরিপকার্য অসম্ভব আর এ সমন্বয় কার্যও দু’ধরনের, যথা— (১) অস্থায়ী সমন্বয়— যা যন্ত্রেরপ্রতিটি অবস্থানেই করতে হয় ও (২) স্থায়ী সমন্বয়- যা যন্ত্রের গঠনে বা পাঠ গ্রহণে বৈকল্য বা ত্রুটি দেখা দিলে করতে হয়।

 

সার্ভেয়িং ১ সূচিপত্র
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

শেষোক্তটির মূলভিত্তি হলো যন্ত্রের অংশগুলোর সমন্বয় ও এগুলোর জ্যামিতিক সম্পর্কের উপর। তাই এ জাতীয় সমন্বয়গুলো যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় করতে হয়। এগুলো করার জন্য বিভিন্ন ধারাবাহিক ধাপ অনুসরণ করতে হয়। এ ধাপগুলোও যন্ত্রের মডেলের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। তাই এ জাতীয় সমন্বয়ের কাজ বেশ জটিল এবং এ কাজে সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির দরকার পড়ে। সর্বোপরি এ কাজগুলো সহজেই ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। এরপরও যন্ত্রের সমন্বয়ের জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় ঃ

(ক) যেহেতু অধিকাংশ জরিপ যন্ত্রের সমন্বয় বহু সংখ্যক সম্পর্কের ভিত্তিতে করা হয়, তাই এক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য প্রথমে এমন দিকগুলোর সমন্বয় করতে হবে, যেগুলো অন্যান্য সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করে না এবং যেগুলো পরবর্তী সমন্বয়গুলোর ত্রুটি বা ভুলের মাত্রা কমিয়ে দেয় । 

(খ) যে-সব সমন্বয়গুলো সম্পূর্ণরূপে একক সমন্বয় অর্থাৎ যে-সব সমন্বয়ের ক্ষেত্রে যন্ত্রের অন্য কোনো সমন্বয়ের উপর নির্ভর করতে হয় না, ঐ সব ক্ষেত্রে পুনঃপুন প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত সমন্বয় করে ধীরে ধীরে যন্ত্রকে ত্রুটিমুক্ত করা যায়।

(গ) প্রথমবারের সমন্বয়েই যন্ত্র ত্রুটিমুক্ত হয়ে যায় না। তাই নিপুণতার সাথে পুনঃপুন সমন্বয়ের মাধ্যমে যন্ত্রকে ত্রুটিমুক্ত করতে হয়।

(ঘ) অনেক সময় যন্ত্র দৃঢ়ভাবে সংস্থাপনের অভাবে সমন্বয় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে যন্ত্রকে শক্ত মাটিতে সংস্থাপন করে সন্তোষজনকভাবে সমন্বয় সম্ভব। 

(ঙ) সমন্বয়কারী ক্রুগুলো শক্তভাবে এঁটে দিতে হবে, যেন এগুলোতে স্পর্শ করলে যন্ত্রের সমন্বয় বিনষ্ট না হয়। বিশেষ করে সমন্বয়ে ব্যবহৃত স্ক্রুগুলো ক্যাপস্টেন হেডেড স্ক্রু হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে নির্দিষ্ট দিকে নির্দিষ্ট মাত্রায় ঘূর্ণনের (Rotation) সুবিধা রাখতে হবে।

(চ) ব্যবহার ক্ষেত্র ও যন্ত্রের ধরনের উপর যে-কোনো যন্ত্রের নির্ভুল সমন্বয়ে টিকে থাকার সময়সীমা নির্ভর করে। যন্ত্রের কোনো কোনো সমন্বয় অন্যান্য সমন্বয় হতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং এগুলো ঘন ঘন পরীক্ষা করে নিতে হয় । সূক্ষ্ম ও নিখুঁত কাজের জন্য প্রত্যহ কাজের পূর্বে যন্ত্র পরীক্ষা করা উচিত। জরিপের ক্ষেত্রে নির্ভুল ফলাফল পাওয়ার জন্য ধরে নেয়া হয় যে, প্রত্যেকটি যন্ত্রই ত্রুটিসম্পন্ন। তাই যন্ত্র সমন্বয়ের পরেও সহজাত সুপ্ত ত্রুটিমুক্ততার জন্য রুটিন অবজারভেশনের (Routine observation) ব্যবস্থা রাখা হয়। 

আরও দেখুন:

Leave a Comment